For the best experience, open
https://m.eimuhurte.com
on your mobile browser.
OthersWeb Stories খেলা ছবিঘরতৃণমূলে ফিরলেন অর্জুন সিংবাংলাদেশপ্রযুক্তি-বাণিজ্যদেশকলকাতাকৃষিকাজ বিনোদন শিক্ষা - কর্মসংস্থান শারদোৎসব লাইফস্টাইলরাশিফলরান্নাবান্না রাজ্য বিবিধ আন্তর্জাতিককরোনাএকুশে জুলাইআলোকপাতঅন্য খবর
Advertisement

দশোহারা তিথিতে গাছই ভগবান রূপে পূজিত হয় নদীয়ার হাঁসখালির ফতেপুরে

07:45 PM Jun 16, 2024 IST | Subrata Roy
দশোহারা তিথিতে গাছই ভগবান রূপে পূজিত হয় নদীয়ার হাঁসখালির ফতেপুরে
Advertisement

নিজস্ব প্রতিনিধি ,হাঁসখালি: একটি দর্শনীয় ও ভক্তির স্থান নদিয়ার হাঁসখালির ফতেপুর গ্রাম্য এলাকা । একধারে তারকাটার বেড়া ,অন্যদিকে বয়ে চলেছে ইছামতি নদী(Ichamoti River) । জ্যৈষ্ঠ মাসের দশরাতে গঙ্গা পূজার দিন এখানে একটি মেলা বসে । ফতেপুর ,ঘোষ কমলপুর, মোবারকপুর, পেপুল বেরিয়া , ছুটিপুর প্রভৃতি অঞ্চলের মানুষের কাছে একটি দর্শনীয় স্থান ও ভক্তির স্থান । এই স্থানকে ঘিরে বাংলাদেশের সীমান্ত সংলগ্ন ঘোড়ামারী ডাঙ্গা ও ঘোড়ামারির মাঠে বসে মেলা । মূলত কৃষি জমির মধ্যে ঘোড়ামারির মাঠ নামে রয়েছে এক চিলতে জমি । সেই জমিতেই গোসাই বাবা বা সাধুবাবার থান রয়েছে । এই স্থানটিকে কেউ বলেন পাগলা বাবার ধাম আবার কেউবা বলেন বুড়ো বাবার ধাম । চারপাশে প্রায় ২ থেকে ৩ কিলোমিটারের মধ্যে কোন বসতি নেই । অথচ প্রতিবছর এই দিনে সকাল থেকে সন্ধ্যেয় মানুষের ঢল নামে এই দর্শনীয় স্থানে । যদিও এই তিথী উপলক্ষে বিভিন্ন স্থানে গঙ্গা পূজা হয় । তবে এই অঞ্চলের মানুষেরা এই স্থানে মনসা পূজো করে থাকেন । অবশ্যই মূর্তি নেই মা মনসার । প্রতীকি পুজো করে থাকেন এখানকার ভক্তরা । আর এই পূজায় নেই কোন নিয়ম বিধি । এখানকার গ্রামবাসীরা আগের দিন রাতে ভাত রান্না করে জল দিয়ে রাখেন আর পরের দিন দশেরা তিথিতে সেই ভাত খেয়ে থাকে, বলা যেতেই পারে এদিন গ্রামে অরন্ধন দিবস পালিত হয় । বুড়ো বাবার পূজার সঙ্গে মনসা দেবীর পূজায় মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় এই পূজার স্থান ।

Advertisement

ঘোড়ামারি , ডাঙ্গাপাড়া নামে পরিচিত এই মাঠ আগে ছিল ফতেপুরবাসী মৌলিক পরিবারের । দেশ ভাগের পরে বেশ কিছুকাল কেটে গিয়েছে । আগে এই মেলাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের ভক্তরাও আসতেন পুজো দিতে । বর্তমানে সীমান্তে তারকাটা হয়ে যাওয়ায় আর বাংলাদেশ থেকে ভক্তরা আসতে পারে না ।গ্রামের স্থানীয় বাসিন্দা ও কবি শিবশেখর গন জানান, জ্ঞানেন্দ্র নাথ মৌলিক নামে এই পরিবারের এক পূর্বপুরুষ ছিলেন । তিনি একদিন ঘোড়ামাড়ির(Ghoramari) মাঠে গিয়েছিলেন চাষের কাজ করতে । এই মাঠের পাশেই ছিল শ্যাওড়া , ঘেটু ও ডুমুর গাছ ঘেড়া এক বিশাল জঙ্গল । গ্রামে এখনকার মত তখন জনবসতি গড়ে ওঠেনি । মৌলিক বাবু নিজের চাষ করার দুই বলদ রেখে কোন এক অজানা কারণে ওই জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করেছিলেন । দুপুর থেকে সন্ধ্যে, সন্ধ্যে থেকে রাত তবুও মৌলিক বাবু বাড়ি ফিরলেন না। রাতের বেলায় গ্রামবাসীরা মাঠে গিয়ে চারদিকে খোঁজাখুঁজি শুরু করলেন তবুও মৌলিক বাবুর কোন দর্শন তারা পেলেন না । অথচ তারা দেখতে পেলেন মৌলিক বাবুর বলদ দুটি অসহায় কাঁধে জোয়াল নিয়ে তাকিয়ে আছে জঙ্গলের দিকে । রাতের অন্ধকারে বলদ দুটি ও ভয় চিৎকার করছে । গ্রামবাসীরা পেলেন না মৌলিক বাবুর কোন খোঁজ খবর । গ্রামের লোকেরা চিৎকার চেঁচামেচি করে ডাকতে শুরু করলেও মৌলিক বাবুর কাছ থেকে কোনরকম সাড়া পায়নি । ফলে গ্রামবাসীরা হতাশ হয়ে বলদ দুটি কে নিয়ে বাড়ি ফিরলেন রাতের অন্ধকারে । এত বড় জঙ্গল গ্রামবাসীরা ভয়ে কিন্তু সেই জঙ্গলের ভিতরে প্রবেশ করতে পারলেন না রাতের অন্ধকারে ।

Advertisement

পরেরদিন সকাল হতেই গাঁয়ের লোক মৌলিক বাবুকে খোঁজাখুঁজি করার জন্য মাঠের ওই স্থানের গভীর জঙ্গলে প্রবেশ করলেন । গ্রামবাসীরা জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করে দেখতে পেলেন গাছ তলায় ধ্যানরত অবস্থায় রয়েছেন মৌলিক বাবু । গ্রামবাসীরা চিৎকার চেঁচামেচি করেও তার ধ্যান ভাঙাতে পারলেন না । দীর্ঘ অপেক্ষা করার পর মৌলিক বাবু তার ধ্যান ভাঙলেন । গ্রামবাসীরা মৌলিক বাবুকে বাড়িতে নিয়ে আসলেন । মাঠ থেকে ফিরে আসার পর মৌলিক বাবু কিন্তু একেবারে অন্যরকম মানুষ হয়ে যান । শান্ত , ধীর, স্থির, মানুষটি যেন এক অন্য মানুষে পরিণত হয়েছে । গ্রামবাসীরা প্রত্যক্ষ করলেন মৌলিক বাবুর মুখ ও কপাল দিয়ে একটা জ্যোতি বেরোতে থাকে । গ্রামবাসীরা তার এই জঙ্গলের প্রবেশ ও ধ্যানমগ্ন নিয়েই বারবার প্রশ্ন করতে থাকেন । দীর্ঘ প্রশ্নের পর অবশেষে মুখ খুললেন মৌলিক বাবু । ইনি গ্রামবাসীদের উদ্দেশ্যে বললেন জঙ্গলে জটাধারী শিব তাকে জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে গাছ তলায় বসান । বুড়ো বাবার দর্শন তিনি পেয়েছেন । সেই বুড়ো বাবাই নাকি তাকে এই গাছতলায় বসে দীক্ষা দিয়েছেন । দীক্ষা স্বরূপ সেই বুড়ো বাবা তাকে শিখিয়ে দিয়েছেন গাছ গাছড়ার মাধ্যমে কিভাবে মানুষের রোগ সারাতে হয় । গ্রামের লোকেরা মৌলিক বাবুর কথায় তারজোব হয়ে যান । গ্রামের মানুষেরা কোনরকম অসুখ হলেই ছুটে যান মৌলিক বাবুর কাছে । আর মৌলিক বাবু তাদের উদ্দেশ্যে গাছ গাছড়ার ওষুধ দেন । এই ওষুধ খেয়েই সকলের রোগ নির্মূল হয়ে যেতে থাকে । সেই থেকেই জ্ঞানেন্দ্র নাথ মৌলিক গুনিন বা কবিরাজ নামে পরিচিত হলেন এলাকাবাসীর কাছে । এই ঘটনার আগে তিনি ছিলেন একজন কৃষক । গুনিন হতেই গ্রাম, জেলা, রাজ্য এমনকি দেশের চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল এই গুনিনের নাম । বহু রোগ সারিয়ে তুললেন, তিনি বহু রোগীদের সুস্থ করলেন । এরপর গ্রামের অনেকেই নাকি সেই যোগী বাবাকে দেখেছে তারপর লোক বিশ্বাস ও সংস্কারের বসে মানুষ ভয়ে ভক্তিতে এই বিশেষ তিথিতে ভিড় জমিয়েছে বুড়ো বাবার ধ্যান মগ্ন বুড়ো বাবার থানে । জ্ঞানেন্দ্র নাথ মৌলিক দেহ রাখার পর বংশ পরস্পরায় মৌলিকেরা কবিরাজি প্র্যাকটিস করে আসছেন এই গ্রামে।

বুড়ো বাবার (Buro Baba)মেলা আরম্ভ হয়েছে খুব বেশি হলে ৩৫ থেকে ৪০ বছর। এই অনুষ্ঠানে এক দিকে দেবী মনসা আর অন্যদিকে বুড়ো বাবার পুজো করা হয়। আলাদা করে দেবীর কোন মূর্তি এখানে প্রতিষ্ঠা হয় না । তিনটে গাছ শেওড়া ,ঘেটু ও ডুমুরকে ভক্তি করে পূজা করেন ভক্তরা । গাছের গোড়ায় সাজানো হয় পূজার উপাচার । হাজার হাজার মানুষ ছুটে আসেন এখানে প্রাণের টানে । বিশেষত যারা রোগ ,অসুখ সারাবার জন্য মানত করেন ফল লাভ করলে সেই উপাচার দিয়ে বাবার থানে পুজো দেন ও দান করেন। সবচেয়ে বেশি মানত করা হয় দেশি মুরগি । ভক্তেরা বাবার নামে এই মুরগি এখানে দান করে যান । ছাগলছানা বা এঁড়ে বাছুর দান করেন । সবচাইতে মজার ব্যাপার এই মুরগি বা ছাগলছানা কেউ কিন্তু ধরে না বা কেউ মেরে খায় না। । জঙ্গলের মধ্যেই মুরগি ছাগল ও এঁড়ে বাছুর ছেড়ে রাখা হয়। । বেশিরভাগ মুরগি যায় শিয়াল বা ভাম বা বন বিড়ালের পেটে । অবশ্য মুরগীদের থাকার জন্য বিএসএফের পক্ষ থেকে একটি টিনের চালা ঘর তৈরি করে দিয়েছে। । সেখানে ই ওরা থাকে রোদ জলে ।আবার এখানেই বংশবিস্তার করে । ফতেপুর বাসীরা বাবার স্থানের কোনো গাছের একটা পাতাও কেউ ছেড়ে না। ভয়ে এবং ভক্তিতে । তাই এখানে গেলে শ্যাওড়া ,ঘেটু ও ডুমুর গাছ দেখতে পাবেন ছাতার মতো ঘিরে রেখেছে পুরো জায়গাটিকে। । বর্তমান সময়ে আর একটা বিশেষ লক্ষণীয় দিক হলো এই থানে হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে মানুষ এখানে আসেন এবং তাদের নিজ ধর্ম অনুযায়ী তারা পুজে দেন। এখানে কাজী নজরুল ইসলামের কথাই মোরা একই বৃন্তে দুইটি কুসুম হিন্দু মুসলমান । তার জলজ্যান্ত প্রমাণ পাওয়া যায় এই স্থানে ।এই বিশেষ দিনে চারপাশের কোন গ্রামেই এদিন রান্না হয় না । সকলেই প্রসাদ পায় মেলায় । প্রসাদ বলতে খিচুড়ি ,ল্যাবড়া, সবজি আর পায়েস । আশপাশের কোন গ্রামে এই বিশেষ দিনেই কোন দুধ কেউ বিক্রি করে না । যত দুধ হয় এই স্থানে নিয়ে গিয়ে পায়েস তৈরি করে এবং ভক্তদের উদ্দেশ্যে বিতরণ করে। । গ্রামের মানুষেরা স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে চাল ,ডাল ,দুধ, চিনি দান করে। বিভিন্ন জায়গায় রান্না করা হয় এবং ভক্তদের ও দর্শনার্থীদের বসিয়ে পেট পুরে খাওয়ানো হয়। জামাইষষ্ঠীর পরিবর্তে চারদিন পরেই এই দশড়রাতেই গ্রামগুলিতে মেয়ে জামাইদের আগমন ঘটে মেলা উপলক্ষে । স্থানীয় বাসিন্দা, বিষ্ণুচরণ ঘোষের কথায় ধনী-দরিদ্র হিন্দু মুসলমান নিরবিশেষে মাটির উপরে বসে পা পেতে প্রসন্ন চিত্তে বনভোজনের মতো খাবার খাচ্ছে । পাশাপাশি এই মেলা উপলক্ষে সমস্ত রাজনৈতিক রং ভুলে গিয়ে একত্রিতভাবে সকলে মিলে হাতে হাত রেখে কাজ করেন । গ্রামবাসীদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন বিএসএফ জওয়ানরা । পুণ্যার্থী ও ভক্তদের যাতে কোন অসুবিধা না হয় সেই জন্য তারা পানীয় জলের ব্যবস্থা করেন । বর্তমান সমাজে গ্রাম বাংলাতে এইরকম দৃশ্য বিরল । মেলায় নেই কোন আরম্ভর , নেই কোনো হোই হুল্লোড় । তবে আছে এই মেলাকে কেন্দ্র করে মানবতা । বলা যেতেই পারে স্থানীয় বাসিন্দারা এই লোক উৎসবের মাঝে খুঁজে পান তাদের পুরনো দিনের স্মৃতি । রিমি ঘোষ নামে এক মানতকারী বলেন ,এইখানে মানত করে ই তার স্বামীর চাকরি হয়েছে । সংসারের আয় উন্নতি হয়েছে ।বলা যেতেই পারে বিজ্ঞানের যুগেও মানুষের বিশ্বাস ও ভক্তিকে এক ফোটাও চির ধরাতে পারেনি । তাইতো আজও কবিরাজের উপরে অনেকেই নির্ভর করেন । শিয়ালদা থেকে গেদে লোকাল ট্রেনে ১২৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বগুলা স্টেশনে নেমে অটো করে ফতেপুর গ্রামে পৌঁছানো যাবে । অন্যদিকে, কৃষ্ণনগর(Krishnanagar) থেকে ফতেপুরের দূরত্ব ৩৫ কিমি । কৃষ্ণনগর থেকে বাসে করে ভাজন ঘাটে নেমে টোটো বা অটো করে এই স্থানে পৌঁছানো যাবে ।

Advertisement
Tags :
Advertisement