নিজের খাত ছেড়ে জনপদে ঢুকে পড়ছে তিস্তা, উদ্বেগে সেচ দফতর
নিজস্ব প্রতিনিধি: নদী নিজের খাত ছেড়ে জনপদে ঢুকে পড়ছে। অর্থাৎ নদীর যেখান দিয়ে বয়ে যাওয়ার কথা সেখানে জল কম, কিন্তু যেখানে গ্রাম সেদিকেই নদী সরে যাচ্ছে। আর তাতেই উদ্বেগে রাজ্যের সেচ দফতর(Irrigation Department)। কেননা যে নদীকে ঘিরে এই উদ্বেগ, সে তো যে সে কোনও নদী নয়। তার নাম তিস্তা(Teesta River)। এখন সেই নদীই নিজের খাত ছেড়ে জনপদ ঘঁষে বয়ে চলেছে(Flowing Dangerously in side of Locality)। সেই সঙ্গে ভেঙে চলেছে নদী বাঁধ। ভাঙছে একের পর এক স্পার। স্পারের মাথা ভাঙছে, দেওয়াল ধসে যাচ্ছে। নদীতে জল বেশি থাকায় সেগুলি মেরামত করতে পারছে না সেচ দফতর। সিকিমে প্রবল বৃষ্টি হওয়ায় তিস্তায় জলের পরিমাণ এখন বিপদসীমার কাছাকাছি। এই অবস্থায় সেচ দফতরের আধিকারিকদের আশঙ্কা, নদীতে জল আরও বাড়লে ভাঙতে পারে বাঁধ। সেক্ষেত্রে তিস্তা সরাসরি গ্রামে ঢুকে পড়বে। তখন কী হবে! এটা ভেবেই আতঙ্কিত সকলে। সেক্ষেত্রে বিহারের বুকে ২০০৫ সালে কোশি যে নদী খাত পরিবর্তনের ভেলকি দেখিয়েছিল সেই একই ভেলকি(Changing of River Course) দেখাতে পারে তিস্তাও। সেক্ষেত্রে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনে জীবিকায় ভয়াবহ বিপর্যয়(Disaster) নেমে আসবে।
গত বছর অক্টোবর মাসে সিকিমে হড়পা বান বিপর্যয়ের পরে তিস্তা তার গতিপথ বদলের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে ধরা পড়েছে উপগ্রহ চিত্রে। নদীর বুকে নানা ধরনের পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। যেমন নদীখাত উঁচু হয়ে যাওয়া, আগের খাত ছেড়ে নতুন খাতে বয়ে যাওয়া, পাড় ঘেঁষে বয়ে চলা। কার্যত তিস্তাকে সামলানোই সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে সেচ দফতরের কাছে। দশকের পর দশক ধরে কোনও দিন দেখা যায়নি, ভরা বর্ষায় তিস্তার বুকে সবুজ চর জেগে উঠেছে। কিন্তু এখন সেটাই দেখা যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, নদী সরে চলে গিয়েছে এক পাশে। জনপদে ঢুকে পড়েছে তিস্তা। এখন সেই কারণেই সব থেকে বড় বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে আছে সেবক লাগোয়া লালটং বস্তি। কেননা এখন সেই বস্তি ঘেঁষেই প্রবল স্রোতে বয়ে চলেছে তিস্তা।
লালটং বস্তিকে তিস্তার গ্রাস থেকে রক্ষা আদৌ করা যাবে কিনা তা নিয়ে সংশয়ে খোদ সেচ দফতরের আধিকারিকেরাও। সঙ্কট শুধু লালটং বস্তিকে নিয়ে নয়। ময়নাগুড়ির বাকালিতেও তিস্তা নিজের খাত ছেড়ে সরেছে ডান দিকে। ভাসিয়ে দিয়েছে গ্রাম। দক্ষিণ চেংমারিতে তিস্তা বাঁদিকে সরে গিয়েছে অনেকটা। জলপাইগুড়ি শহর লাগোয়া মিলনপল্লির বীরেন বস্তি এলাকাতেও তিস্তা নদী ডান দিক দিয়ে বয়ে চলেছে। প্রবল বেগে জল বইছে। জলের পরিমাণও অত্যন্ত বেশি। সে কারণে এক দিনে যতটুকু ভাঙন ঠেকানোর কাজ করা যেত, সেটি করতে এখন চারদিন লাগছে। সেই সঙ্গে প্রবল বৃষ্টিও কাজে সমস্যা করেছে। তবু লালটঙে নদীতে ব্যারিকেড বসিয়ে জনপদ রক্ষা করার মতো চেষ্টা চলছে।
নদী বিশেষজ্ঞদের দাবি, তিস্তার ইতিহাসে ডুব দিলে দেখা যাবে, হিমালয় থেকে নেমে আসা এই নদী বার বার তার খাত পরিবর্তন করেছে। একসময় তিস্তার ৩ প্রধান শাখা নদী করতোয়া, আত্রাই ও পুনর্ভবা দিয়ে তিস্তার ৯০ শতাংশ জল প্রবাহিত হয়ে গঙ্গায় মিশতো। বাকি ১০ ভাগ জল ক্ষীণ ধারায় বুড়ি তিস্তা নাম নিয়ে ব্রহ্মপুত্রে গিয়ে পড়তো। কিন্তু ১৭৮৭ সালে এক বিধ্বংসী বন্যার মাধ্যমে তিস্তা তার গতিপথ বদল করে আজকের চেহারা নেয়। সরাসরি সে বয়ে গিয়ে পড়ছে ব্রহ্মপুত্রের বুকে। আর তিস্তা থেকে সম্পূর্ণ ভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে করতোয়া, আত্রাই ও পুনর্ভবা। এখন নদী বিশেষজ্ঞদের দাবি, তিস্তা আবারও তার পুরাতন পথেই ফিরতে চাইছে। আর তাই সে এখন ক্রমশ মাঝ খাত দিয়ে বয়ে যাওয়ার বদলে জনপদ ঘেঁষে বয়ে চলেছে। তিস্তার এটা কোনও খেয়ালী বা মরশুমী প্রবাহ নয়। বরঞ্চ এটাই হিমালয় থেকে নেমে আসা অধিকাংশ নদীর চরিত্র। তাই হাজারো স্পার দিয়ে তিস্তার গতি ঠেকানো সম্ভবত সফল হবে না। তিস্তা ফিরতে চাইছে তার পুরাতন ত্রিস্রোতার স্রোতে, মানে করতোয়া, আত্রাই ও পুনর্ভবার স্রোতে।