জোর টক্কর সুদীপ-তাপসের, তাল ঠুকছেন কংগ্রেসের প্রদীপ
নিজস্ব প্রতিনিধি: চলতি ভোটে গোটা রাজ্যবাসীর কাছে জোর চর্চার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে কলকাতা উত্তর লোকসভা আসনের লড়াই। তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে বিজেপির হয়ে দাঁড়িয়েছেন সদ্য প্রাক্তনী তৃণমূল নেতা তাপস রায়। এক সময়ে দুজনেই ঘাসফুল শিবিরের অন্যতম সেনাপতি ছিলেন। কিন্তু রাজনীতির পাশা খেলায় দু’জনে আজ সন্মুখ সমরে। বিনা যুদ্ধে কেউ কাউকে যে এক ইঞ্চি জমি ছাড়বেন না তা স্পষ্ট। আর দুই ফুলের দুই প্রার্থীর লড়াইয়ে জয়ের তাল ঠুকছেন রাজ্য কংগ্রেসের প্রবীণ নেতা তথা রাজনীতির বহু উত্থান-পতনের সাক্ষী প্রদীপ ভট্টাচার্য। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, চলতি ভোটে কলকাতা উত্তর আসনে লড়াইটা কার্যত তিন সেয়ানের মধ্যে। আর ওই লড়াইয়ে অঘটন ঘটলেও ঘটতে পারে।
চৌরঙ্গী, এন্টালি, বেলেঘাটা, জোড়াসাঁকো, শ্যামপুকুর, মানিকতলা এবং কাশীপুর-বেলগাছিয়া বিধানসভা কেন্দ্র নিয়ে গঠিত কলকাতা উত্তর। গত বিধানসভা সভা সাতটি আসনেই জিতেছিলেন শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থীরা। বাঙালির পাশাপাশি কলকাতা উত্তর লোকসভা আসনে অবাঙালি এবং অবাঙালি মুসলিমদের সংখ্যাও বিশেষভাবে উল্লেখ্যনীয়। আর মুসলিম এবং অবাঙালি হিন্দুদের মধ্যে আড়াআড়ি বিভাজন গত কয়েক বছর ধরে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। একদল শাসক শিবিরে ভিড়েছেন তো অন্য দল কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংগঠন বিজেপিকে আঁকড়ে ধরেছেন। আর ওই বিভাজনে বাম ও কংগ্রেস অনেকাংশেই কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। গত বছর সাতেক ধরেই দুই দলের ভোট ব্যাঙ্কে লাগাতার শক্তিক্ষয় ঘটেছে। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে কলকাতা উত্তরের সাত কেন্দ্রেই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছিল বাম-কংগ্রেস।
কিন্তু চলতি লোকসভা ভোটের মুখে আচমকাই রাজনৈতিক বাতাবরণে বদল ঘটেছে। বিদায়ী সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকা নিয়ে তৃণমূলের অন্দরেই ক্ষোভ বেড়ে চলেছে। দিন দিন অসন্তোষ বেড়েছে। বিশেষ করে উত্তর কলকাতায় তৃণমূলের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে যারা জড়িত, তারা দলে গুরুত্ব পাচ্ছেন না বলে বিদ্রোহও করেছেন। মূলত সেই বিদ্রোহীদের অন্যতম সেনাপতি ছিলেন বরাহনগরের প্রাক্তন বিধায়ক ও রাজনৈতিক ‘হাওয়া মোরগ’ হিসাবে খ্যাত তাপস রায়। তিনি আশায় ছিলেন, সুদীপকে সরিয়ে তাঁকেই কলকাতা উত্তরের মুখ হিসাবে তুলে ধরবে তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্ব। কিন্তু সেই আশা পূর্ণ হয়নি। ফলে ভোটের মুখে দল ও বিধায়ক পদে ইস্তফা দিয়ে সোজা পদ্ম ফুল শিবিরে নাম লিখিয়ে রাজনৈতিক শত্রু সুদীপের বিরুদ্ধে প্রার্থী হয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে তৃণমূল সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে দলের ভোট মেশিনারী সম্পর্কে যথেষ্টই অবহিত। শুধু তাই নয়, তৃণমূলের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গেও সখ্যতা রয়েছে। বিজেপির নিজস্ব ভোট ব্যাঙ্কের পাশাপাশি তৃণমূলের ভোট ব্যাঙ্কে সিঁদ কেটে জয় হাসিল করার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী তাপস।
যদিও এক সময়ের সতীর্থর প্রতিপক্ষ হিসাবে লড়াইয়ের আসরে অবতীর্ণ হওয়াকে গুরুত্বই দিতে চাইছেন না পোড়খাওয়া রাজনীতিবিদ তথা সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। গত দেড় দশক সাংসদ থাকার সুবাদে এলাকার উন্নয়নে তিনি যে কাজ করেছেন, তার নিরিখেই চলতি ভোটে বাজিমাত করার ব্যাপারে অনেকটা নিশ্চিত তিনি। বাঙালিদের পাশাপাশি অবাঙালি ভোটারদের সমর্থনও পাওয়ার বিষয়ে আত্মপ্রত্যয়ী বিদায়ী সাংসদ।
কলকাতা উত্তর আসনে ভোট ময়দানে বাম-কংগ্রেসের হয়ে রয়েছেন রাজ্য রাজনীতির বহু উত্থান-পতনের ইতিহাসের সাক্ষী থাকা প্রদীপ ভট্টাচার্য। ভদ্রলোকের পাশাপাশি শিক্ষিত-রুচিশীল ও মার্জিত স্বভাবের রাজনীতিবিদ অবশ্য সুদীপ-তাপসের ভোট কাটাকুটির খেলায় মধ্যখান থেকে বাজিমাতের আশা করছেন। উত্তর কলকাতা একসময়ে কংগ্রেসের দুর্গ ছিল। ৩৪ বছরের বাম জমানাতেও সেই দুর্গের ভিত টলেনি। এক সময়ের কংগ্রেসি ভোটাররা পরিস্থিতি বদলের সঙ্গে সঙ্গে তৃণমূলের দিকে ঝুঁকেছেন। সেই ভোটাররা ফের কংগ্রেসের দিকেই ফিরবেন বলে আশাবাদী। উল্টোদিকে কট্টর হিন্দুত্ববাদীদের বাড়বাড়ন্ত রুখতে সংখ্যালঘু ভোটাররাও তাঁকে সমর্থন জানাবেন বলে মনে করছেন মধ্য কলকাতার এক কলেজের প্রাক্তন অধ্যাপক। শেষ পর্যন্ত কলকাতা উত্তরের ভোটাররা কার উপরে নিজেদের আস্থা রাখেন তা জানতে ৪ জুন পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে।