বসিরহাটে দাগ কাটতে ব্যর্থ বিজেপির রেখা, জয় নিশ্চিত হাজি নুরুলের
নিজস্ব প্রতিনিধি, বসিরহাট: সন্দেশখালিকাণ্ড নিয়ে গোটা দেশেই শোরগোল ফেলে দিয়েছিল। লোকসভা ভোটের আগে অনেকটাই ব্যাকফুটে ফেলে দিয়েছিল রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসকে। ফলে সন্দেশখালি যে লোকসভা কেন্দ্রের অধীনে, সেই বসিরহাটে কী ফলাফল হবে তা নিয়ে জোর চর্চাও শুরু হয়েছিল। একটা সময়ে মনে হয়েছিল, কঠিন লড়াইয়ের মুখে পড়তে হবে ঘাসফুল শিবিরকে। কিন্তু সন্দেশখালিকাণ্ড নিয়ে স্টিং অপারেশনের ভিডিয়ো ভাইরাল হতেই হাওয়া ঘুরতে শুরু করেছে। আর তাতেই ভোটের পাঁচদিন আগে ঝোড়ো হাওয়া বইতে শুরু করেছে শাসকদল তৃণমূলের অনুকুলে। বামেরা ভোটের লড়াইয়ে রয়েছে বটে, কিন্তু তা কার্যত খাতা-কলমে। এক সময়ের দুর্ভেদ্য দুর্গে লাল এখন ফিকে হতে হতে কার্যত মুছে যেতে বসেছে।
কৃষি আর ভেড়ি অধ্যুষিত বসিরহাট লোকসভা কেন্দ্রে প্রথম ঘাসফুল ফুটেছিল ২০০৯ সালের নির্বাচনে। উত্তর ২৪ পরগনা জেলা পরিষদের সদস্য হাজি নুরুল ইসলাম চার বারের সিপিআই সাংসদ অজয় চক্রবর্তীকে পরাজিত করে প্রথমবার সংসদে পা রেখেছিলেন। তার পর থেকে গত দেড় দশক ধরে তৃণমূলের দখলেই রয়েছে বসিরহাট লোকসভা আসন। যদিও তিন বারে ঘাসফুলের হয়ে তিন জন সংসদে গিয়েছিলেন। দেড় দশক বাদে বসিরহাট দখলে রাখতে তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্বের এবারের তুরুপের তাস দলের বর্ষীয়ান নেতা ও সংখ্যালঘু মুখ হাজি নুরুল ইসলাম।
পরিসংখ্যানের নিরিখে বসিরহাট কার্যত তৃণমূলের অন্যতম নিরাপদ আসন হিসাবেই চিহ্নিত। কেননা যে সাত বিধানসভা আসন নিয়ে গঠিত জল-জমি-ভেড়ি ঘেরা লোকসভা আসনটি, সেই সাত কেন্দ্রেই তৃণমূলের বিধায়ক। যদিও মিনাখাঁর বিধায়ক ঊষারানি মণ্ডল ইদানিং বিজেপিমুখো। হাড়োয়ার সভায় বেনজিরভাবেই দলীয় বিধায়কের কর্মকাণ্ড ও ভূমিকা নিয়ে ক্ষোভ উগরে দিয়েছিলেন খোদ তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিধানসভার পাশাপাশি পঞ্চায়েত নির্বাচনেও একাধিপত্য বজায় রেখেছে শাসকদল। তবে বিক্ষিপ্ত কিছু এলাকায় আইএসএফ, বাম ও বিজেপি ভালো ফল করেছে। সংখ্যালঘুদের পাশাপাশি বসিরহাট লোকসভা কেন্দ্রের ফলাফল নির্ণায়কের ভূমিকায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে তাকে আদিবাসী এবং বাংলাদেশ থেকে আসা উদ্বাস্তুরা। এক সময়ে আদিবাসী ও উদ্বাস্তু ভোটব্যাঙ্ক বামেদের দখলে থাকলেও রাজ্যে ক্ষমতার পালাবদলের পরে বার বার নিজেদের রাজনৈতিক আনুগত্য বদল করেছে দুই শ্রেণির ভোটাররা। এক অংশ ঝুঁকেছে বিজেপির দিকে। অন্য অংশ রয়েছে ঘাসফুল শিবিরের সঙ্গে।
২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে তিন লক্ষেরও বেশি ভোটে তৃণমূল প্রার্থী জিতেছিলেন। ঘাসফুল শিবিরের দুর্গে সিঁদ কাটতে কট্টর হিন্দুত্ববাদী সায়ন্তন বসুকে দাঁড় করিয়েছিল। তাতে লাভ হয়নি। মোদি ঝড় মৃদুমন্দ বাতাস হয়েও বয়ে যেতে পারেনি বসিরহাটে। এবারের ভোটে তৃণমূলের পাশাপাশি প্রার্থী বদল করেছে বিজেপি। সন্দেশখালিকাণ্ডে স্বঘোষিত নির্যাতিতা রেখা পাত্রকে প্রার্থী করেছে। কিন্তু শুরুতে ভোটারদের মনে খানিকটা ‘দাগ’ কাটতে পারলেও স্টিং ভিডিয়োর জেরে বিজেপি প্রার্থীর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে বড়সড় প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। সমাজমাধ্যমে নানা ‘মিম’ও তৈরি হয়েছে বিজেপির রেখাকে নিয়ে। ব্যাকফুটে যাওয়া তৃণমূল নেতৃত্ব সন্দেশখালি নিয়ে দলের ভাবমূর্তিতে যে ক্ষত তৈরি হয়েছিল তাতে প্রলেপ দিতে খানিকটা সক্ষম হয়েছেন। বামেরা প্রাক্তন বিধায়ক নিরাপদ সর্দারকে প্রার্থী করে মূলত তফশিলি জাতি-উপজাতির ভোট ব্যাঙ্ক ফিরে পাওয়ার মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু সংগঠন না থাকায় ১৮ লক্ষের বেশি ভোটারের কাছে পৌঁছতেই পারেনি। তাই সিপিএমের প্রার্থীর ‘থার্ড বয়’ হয়ে থাকা ছাড়া আর কোনও গত্যন্তর নেই। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষরা মনে করছেন, ‘প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়া খানিকটা বয়ে চললেও বসিরহাটে ঘাসফুলের দুর্গ টলানোর মতো শক্তি নেই সেই হাওয়ার। গত বারের চেয়ে জয়ের ব্যবধান কমলেও তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী হাজি নুরুলের তৃতীয়বার সংসদে যাওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা।’