‘আদালতকে ন্যায় এবং বিচারের মন্দির ভেবে বিচারকদের দেবতা ভাবা ভুল’, বার্তা প্রধান বিচারপতির
নিজস্ব প্রতিনিধি: দেশের প্রথম সুপ্রিম কোর্ট(Supreme Court) তৈরি হয়েছিল কলকাতাতেই(Kolkata)। পরবর্তীতে কলকাতা হাইকোর্টের(Calcutta High Court) জন্ম হয় ১৮৭৪ সালে। ১৮২৫ সালে ব্রিটিশদের হাতে দেশের প্রথম আইনজীবীদের সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ হয় বার লাইব্রেরি ক্লাবের। সেই বার লাইব্রেরির দ্বিশতবর্ষ উপলক্ষে কলকাতায় এসে একটি আইনি সম্মেলনে যোগ দিলেন দেশের সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়(Chief Justice D Y Chandrachud)। আর সেই সম্মেলনে নিজের বার্তার মাধ্যমেই দেশের বিচারব্যবস্থা সহ আমজনতাকে বড় বার্তা দিয়ে দিলেন তিনি। এদিনের সম্মেলনে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়(Mamata Banerjee) এবং কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি টি এস শিবাজ্ঞানমের উপস্থিতিতেই সেই বার্তা দেন দেশের সর্বোচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতি। তিনি জানিয়ে দেন, ‘মানুষ আদালতকে ন্যায় এবং বিচারের মন্দির ভেবে বিচারকদের দেবতা ভাবলে তা বড় ভুল হয়ে যাবে। এমনকি আমরা নিজেরা যদি নিজেদের সেই মন্দিরের দেবতা ভেবে ভুল করি তবে এটা খুব বিপদের। আমার সামনে আদালতকে মন্দির বললে বাধা দিই। বিচারকরা মানুষ এবং সংবিধানের সেবক। বিচারকরা মানুষের সম্বন্ধে আগেভাগে কোনও ধারণা তৈরি করে বিচার করেন না… তাই তাঁদের দেবতা ভাবাটা ঠিক নয়।’
দেশের প্রধান বিচারপতির কথায়, ‘সাংবিধানিক নৈতিকতা বলছে, এক জন ভারতীয় যেমন চায় তেমন ভাবতে পারে, যেরকম চায় বলতে পারে, যাকে চায় তাঁকে পুজো করতে পারে, যাকে অনুসরণ করতে চায় করতে পারে। যা চায় খেতে পারে, যাকে চায় বিয়ে করতে পারে। সংবিধান কোনও কিছুতেই মানুষের মধ্যে বিভেদ তৈরি করে না। এই আলোচনাচক্র দেশের বিচার ব্যবস্থাকে উন্নত করার জন্য করা হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির সাহায্যে বিচার ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করার জন্য আয়োজিত হয়েছে। বিচারকেরা বিচার করুন, কিন্তু অন্যের সম্পর্কে আগেভাগে কোনও ধারণা তৈরি করে ফেলবেন না। সহানুভূতি রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, আমাদের সামনে যাঁরা দাঁড়িয়ে থাকেন, তাঁরা মানুষ। বিচারপতিরা যেন সমাজের প্রতি তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার না করেন। বিচার করতে হবে সমাজকে নিয়ে সংবিধান মাথায় রেখে। সাংবিধানিক নৈতিকতা বলে যে, বৈচিত্রকে গ্রহণ করো এবং সহনশীল হও। তথ্যপ্রযুক্তি আমাদের সুযোগ দিয়েছে যাতে আমরা যে রায় দিই, তা অন্য ভাষায় অনুবাদ করার। আমরা ৫১ হাজারের বেশি রায় অন্য ভাষায় অনুবাদ করছি। বাংলা এবং ওড়িয়া-সহ সংবিধান যে ভাষাকেই স্বীকৃতি দেয়, সেই সব ভাষায় অনুবাদ করা হয় রায়। আমি বিশেষ করে বাংলা এবং ওড়িয়া ভাষার উল্লেখ করছি। আমার স্ত্রী ওড়িয়া ভাষা ভালবাসে। বাংলা ভাষাও খুব কাছের।’
এদিন দেশের প্রধান বিচারপতি এটাও বলেছেন যে, ‘অনেক হাইকোর্ট জামিনের জরুরি আবেদনের ক্ষেত্রেও তৎপরতা দেখায় না। আমি এটা নিয়ে চিন্তিত। এটা বিচারব্যবস্থার আদর্শ মডেল নয়। সাধারণ মানুষের একটা ধারণা হয়ে গিয়েছে, মামলায় সময় চাওয়াই যেন দস্তুর। কোনও সহকর্মী আইনজীবীর প্রয়াণে সারাদিন এজলাসে কাজকর্ম বন্ধ রেখে কার্যত ছুটি কাটানোর প্রবণতাও ভালো নয়। মানুষ বিচার পাওয়ার জন্য কাঁদছে। সেখানে এভাবে আইনজীবীদের ছুটির বিলাসিতায় একজন অভিযুক্ত জামিন পাচ্ছেন না। কত মানুষের জীবনে অন্ধকার নেমে আসছে! জুনিয়র আইনজীবীদের কাজ শেখানোর নামে বিনা পয়সায় কাজ করানোর দিন আর নেই। জুনিয়রদের সম্মানজনক পারিশ্রমিক দিন। সিনিয়র আইনজীবীদের সঙ্গে বিচারপতিদেরও সাধারণ মানুষের মন বোঝার জন্য নিচুতলার কর্মীদের সঙ্গে প্রতিদিন সহজভাবে কথা বলা উচিত। অবশ্য এটা আমার ব্যক্তিগত অভিমত। আমি বলছি না আমাকে অনুসরণ করুন। কিন্তু এগুলো করলে হয়তো আদালত ও বিচারপতিদের সঙ্গে সঙ্গে আইনজীবীদের প্রতি আমজনতার ধারনায় কিছু পরিবর্তন আসবে। এখন মানুষ উকিল আর আদালতের নাম শুনলেও ভয় পান। এটা গণতন্ত্রের পক্ষে মঙ্গল নয়।’