অতীতের লালদুর্গে চতুর্মুখী লড়াই, তবুও পাল্লাভারী সায়নীর
নিজস্ব প্রতিনিধি: অতীতের লালদুর্গ ইদানিং তৃণমূল কংগ্রেসের শক্ত ঘাঁটি যাদবপুরে এবার লোকসভা ভোটে চতুর্মুখী লড়াই। চার লক্ষ্য সামনে রেখে লড়ছেন চার প্রতিপক্ষ। প্রথমজনের লক্ষ্য জয়ের ব্যবধান বাড়ানো। দ্বিতীয় জনের লক্ষ্য হারানো জমি পুনরুদ্ধার। তৃতীয় জনের লক্ষ্য ভোট কাটাকুটির খেলায় বাজিমাত করা। আর চতুর্থ লড়ছেন নিজের নাক কেটে অপরের যাত্রাভঙ্গ (পড়ুন তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থীর) করা। প্রথমজন হলেন তৃণমূল কংগ্রেসের সায়নী ঘোষ। দ্বিতীয় জন সিপিএমের সৃজন ভট্টাচার্য। তৃতীয় জন পদ্ম শিবিরের অনির্বাণ গঙ্গোপাধ্যায় আর চতুর্থজন হলেন আইএসএফের নুর আলম খান।চতুর্মুখী লড়াই হলেও সাংগঠনিক শক্তি আর জনসংযোগের নিরিখে তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থীর যে পাল্লাভারী তা নিয়ে সংশয় নেই রাজনৈতিক পণ্ডিতদের।
আসন পুনর্বিন্যাসের পরে ১৯৭৭ সালে যাদবপুর আলাদা লোকসভা আসনের স্বীকৃতি পেয়েছিল। প্রথম থেকেই সিপিএমের দখলে ছিল। ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা গান্ধির মৃত্যুর পরে সিপিএমের জাঁদরেল নেতা সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে হারিয়ে ইতিহাস গড়েছিলেন তৎকালীন যুব কংগ্রেস নেত্রী তথা বর্তমান তৃণমূল কংগ্রেস সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শেষ বার ২০০৪ সালে সিপিএম প্রার্থী জিতেছিলেন এই আসনে। তার পর থেকে গত ১৫ বছর ধরে আসনটি ঘাসফুল শিবিরের দখলে। যদিও তিন তিনটি নির্বাচনে তৃণমূলের হয়ে তিন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। কোনও প্রার্থীই পর পর দু’বার দাঁড়াননি। গতবার যিনি জয়ী হয়েছিলেন সেই টলি অভিনেত্রী মিমি চক্রবর্তীকে সরিয়ে এবার প্রার্থী হয়েছেন আর এক অভিনেত্রী সায়নী ঘোষ।
যে সাত বিধানসভা আসন নিয়ে যাদবপুর গঠিত তার মধ্যে ছয়টি শাসকদল তৃণমূলের দখলে। শুধু ভাঙড়ে জিতেছিলেন বাম-কংগ্রেস জোটের প্রার্থী আইএসএফ নেতা নওশাদ সিদ্দিকী। কার্যত আধা শহর আর গ্রামীণ এলাকা নিয়েই গঠিত যাদবপুর। অধিকাংশ ভোটারই নিম্ন ও স্বল্প আয়ের। বেসরকারি চাকরি, ব্যবসা আর কৃষিকার্য ও মৎস্যচাষই প্রধান জীবিকা। ভাঙড়, টালিগঞ্জ, বারুইপুর পুর্ব ও বারুইপুর পশ্চিম কেন্দ্রে লক্ষ্যণীয় সংখ্যায় সংখ্যালঘু ভোটার রয়েছেন। সেই সঙ্গে যাদবপুর, টালিগঞ্জের মতো এলাকায় পূর্ববঙ্গ থেকে আসা উদ্বাস্তু ভোটারদের সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য। যারা গত কয়েক দশকে বার বার নিজেদের রাজনৈতিক আনুগত্য বদলে চলেছেন। আর ওই আনুগত্য বদলে ভোটের ফলাফল বার বার বদলেছে।
এবারের লোকসভা ভোটে তৃণমূল কংগ্রেস বাজি ধরেছে দলের যুব সংগঠনের সভানেত্রী, ডাকসাইটে, বলিয়ে-কইয়ে হিসাবে পরিচিত সায়নী ঘোষের উপরে। শক্তিশালী সংগঠন যেমন তাঁর অন্যতম তুরুপের তাস, তেমনই মানুষের কাছে নিমিষে পৌঁছে যাওয়ার গুণ তাঁকে অনেকটাই বাড়তি সুবিধা দিচ্ছেন। তবে সায়নীর সবচেয়ে বড় উদ্বেগের জায়গা ভাঙড়। গতবার মিমি চক্রবর্তী লক্ষাধিক ভোটের লিড পেয়েছিলেন সংখ্যালঘু অধ্যুষিত বিধানসভা আসন থেকে।
সিপিএমের প্রার্থী তরুণ মুখ সৃজন ভট্টাচার্য দলের দুর্গ পুনরুদ্ধারে চেষ্টার ত্রুটি রাখছেন না। সংবাদমাধ্যমের একাংশের করুণায় যথেষ্টই পরিচিত মুখ। কিন্তু গত ১৩ বছর ক্ষমতায় না থাকার কারণে সিপিএমের সংগঠন বলে কিছু আর অবশিষ্ট নেই। তাছাড়া আইএসএফ আলাদা প্রার্থী দেওয়ায় ভাঙড়-সহ বিভিন্ন বিধানসভা কেন্দ্রের সংখ্যালঘু ভোটারদের ভোট কতটা পাবেন তা নিয়ে সংশয় থাকছে।
অন্যদিকে বিজেপি’র যিনি প্রার্থী সেই অনির্বাণ গঙ্গোপাধ্যায় হিন্দুদের ভোট একত্রিত করার চেষ্টায় দিন-রাত পরিশ্রম করে চলেছেন। বারুইপুর, সোনারপুরে খানিকটা প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়া রয়েছে। সেই হাওয়া কাজে লাগাতে চাইছেন তিনি। কিন্তু নিজেকে পরিচিত করতেই অনেকটা সময় চলে গিয়েছে তার। আইএসএফের হয়ে যিনি দাঁড়িয়েছেন সেই নুর আলম খান ভাঙড়ে নিজেদের গড় ধরে রাখতেই বেশি ব্যস্ত। সংখ্যালঘু ভোট ব্যাঙ্কে ভাঙন ধরিয়ে তৃণমূলের জয় রোখাই যে তাঁর প্রধান লক্ষ্য তা পরিস্কার। সবমিলিয়ে এক টানটান লড়াই চলছে যাদবপুরে। কেউ-কেউ মনে করছেন, খুব সহজ হবে না শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের জয়। যদিও রাজনৈতিক পণ্ডিতদের অধিকাংশ মনে করছেন, লক্ষ্মীর ভান্ডার-সহ রাজ্য সরকারের একাধিক প্রকল্পের সুফল ঘরে তুলবেন তৃণমূল প্রার্থী।